সোনালী দিনলিপি

ডরিস লেসিং এর ‘দ্য গোল্ডেন নোটবুক’ সম্ভবত আমার পড়া সবচেয়ে অস্বস্তিকর উপন্যাস। গেল শতাব্দীর পঞ্চাশের মধ্যভাগে ইউরোপের একজন স্বাধীন নারীর ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক এবং সর্বোপরি আটপৌরে অভিজ্ঞতার বর্ণণা করতে গিয়ে লেসিং মানবমনের এতটাই ব্যবচ্ছেদ করেন, টানা একটা তীব্র অস্বস্তির মধ্যে না থেকে পাঠকের আসলে অন্য কোন উপায় থাকে না। বইটি লেখার পরের দশক থেকেই ইউরোপে যৌন স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়, যার পর নারী-পুরুষের প্রথাগত সম্পর্কের অভিনব পরিবর্তন হয় আর ইতিহাসে প্রথমবারের মত নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা পাওয়ার সুযোগ তৈরী হয়। লেসিং এর উপন্যাসটি এই যৌন বিপ্লব হওয়ার পূর্বের দশকের অস্বস্তি দ্বারা তীব্রভাবে আক্রান্ত। মননে পুরোপুরি স্বাধীন কিন্তু সমাজের শৃঙ্খলে কার্যত বন্দী একজন নারীর মানসিক অভিজ্ঞতা অনুপূঙ্খভাবে শব্দে বন্দী করতে গিয়ে তার প্রতিটি অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত অন্যান্য পাত্রপাত্রীদের মানসের সামগ্রিক ব্যবচ্ছেদ করতে হয় লেসিংকে। এভাবে প্রতিটি চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে প্রতিটি চরিত্রেরই পতন ঘটান তিনি; কোন মানুষের মধ্যেই আমরা আর নিষ্কলুষ কিছু দেখি না, সবাই পরিণত হয় একেকটি উন্নত সরীসৃপে। কিন্তু চরিত্ররা এতটা হতাশাবাদী হওয়ার পরও লেখক নিজে থাকেন আশ্চর্য্যরকম নির্লিপ্ত। সকল যাবতীয় মানবিক স্খলন লেসিং এর নির্লিপ্ত কলমে পরিণত হয় নিরাবেগ সত্যভাষণে। কোন অভিযোগ নেই লেসিং এর যেন, শুধু আছে মানুষের চরিত্রের মূলে যেতে পারার অদম্য এক আকাঙ্খা।

নারীবাদে প্রবল আক্রান্ত উপন্যাসটিতে সমান্তরালে পাওয়া যায় পাশ্চাত্যের তৎকালীন বিদ্বৎসমাজে কমিউনিজম-মোহমুক্তির সুতীব্র বেদনাবোধ।  সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম রাষ্ট্র যেটি সকল মানুষের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন আর মানুষের সামগ্রিক মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। কিন্তু স্তালিনের অন্ধকারময় দীর্ঘ শাসনের পর সেই স্বপ্ন প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে পড়ে। যারা তাদের সকল আশা স্থাপন করেছিলো একটি দেশের উপর, তাদের জন্য সেই দেশটির আরেকটি তীব্র কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার বাস্তবতা স্বভাবতই সুখকর কিছু ছিলো না। লেসিং নিজেই ছিলেন সেই গোষ্ঠীর একজন, যারা স্তালিনের প্রথমদিকের দমন নিপীড়নকে বিভিন্ন কষ্টকল্পিত কারণ দেখিয়ে লঘু করতে চেয়েছেন; কিন্তু পরবর্তীতে একটা সময় তাদের মোহভঙ্গ হয় যখন তারা শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারেন উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক, চরম ঘৃণ্য উপায়কে তা কখনোই ন্যায়সঙ্গত করতে পারে না। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেসিং মূলত তার নিজের রাজনৈতিক মোহমুক্তির কথাই বলেছেন।

‘দ্য গোল্ডেন নোটবুক’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম আন্না উলফ। প্রায় একশো বছর আগের আরেক আন্না’র সাথে এই বিংশ শতাব্দীর আন্না’র তুলনা করার ইচ্ছে পেয়ে বসে হঠাৎ। একশো বছরের ব্যবধানে আন্নার ব্যাপক পরিণতিবোধে মুগ্ধ হই। আগের থেকে অনেক বেশি স্বাধীন, মৌলিক, সচেতন এই আন্না। কিন্তু তারপরও মনের ভেতরে তাড়িয়ে বেড়ায় এক বেয়ারা শিশুতোষ প্রশ্ন- আন্না উলফ কি পেরেছে আন্না কারেনিনা থেকে বেশি সুখী হতে? নাহ্, একদমই দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশ্ন, যার কনক্রিট কোন উত্তর পাওয়া সম্ভব নয় কখনোই। বরং শিল্পের আদর্শের সাথে সঙ্গতি রেখে নৈর্ব্যত্তিকভাবে এই দুই চরিত্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে, কোন চরিত্রটি বেশি সফল?

শিল্পকে জীবনের খুব কাছাকাছি মনে হয় বেশির ভাগ সময়েই, কিন্তু কিছু সময়ে মনে হয় বিশুদ্ধ শিল্পচর্চা হয়তো একমাত্র জীবন থেকে পালিয়ে গিয়েই করা সম্ভব।

 

(ডরিস লেসিং; দ্য গোল্ডেন নোটবুক)

Leave a comment