হিন্দুধর্মের স্বরূপ-সন্ধানঃ তৃতীয় পর্ব

(প্রথম পর্ব এখানে)

(দ্বিতীয় পর্ব এখানে)

৫. হিন্দুধর্মের এই সূক্ষ স্বরূপের সন্ধানে ব্যাপৃত হওয়ার পূর্বে আরেকটি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা সারা জরুরী।

সভ্য মানুষের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বস্তুর নাম জ্ঞান। এই জ্ঞানই মানুষকে তার সহজাত প্রবৃত্তিমূলক পশুত্ব অতিক্রম করার ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু, মানুষের জ্ঞানান্বেষণের ইতিহাস কখনোই মসৃণ থাকেনি। জ্ঞানের সাধকদের উপর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন হয়নি এরকম কোন দেশ বা সময় পাওয়া দুর্লভ। তবে জ্ঞানান্বেষণে বাধা হিশেবে সব কাল বা দেশে নির্যাতন ছাড়াও এমন অনেক প্রভাবক কাজ করেছে, যাদের উপস্থিতি সহজে টের পাওয়া যায় না। এরকম একটি প্রভাবক নিয়েই এখন আমাদের আলোচনা করতে হবে।

সেই আদিম কাল থেকে মানুষকে জ্ঞানান্বেষণের সাথে সম্পর্কিত একটি মৌলিক প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হয়েছে। প্রশ্নটি হলো, জ্ঞানার্জনের পথ কি সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে? আমরা বলতে বাধ্য, এই প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা আজও শেষ হয়ে যায়নি। আধুনিক সময়ে যেখানে সকল মানুষের সমঅধিকারে আমরা পূর্ণ আস্থা রাখি, সেখানে এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনকে মনে হতে পারে বর্বর ও ধৃষ্টতাপূর্ণ। আলোচনার এই পর্যায়ে এহেন বর্বর প্রশ্ন কেন উঠছে, তার যৌক্তিকতা বিবেচনা করতে গেলে আমাদের অবশ্য জ্ঞানার্জনের মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য আর এদের সাথে বর্তমান প্রবন্ধের সংযোগের বিষয়টি বুঝতে হবে।

আদি কাল হতে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের সকল জ্ঞানের মৌলিক ও চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নিজের অস্তিত্বকে বুঝতে চাওয়া। আদিম হোমো স্যাপিয়েন্সের যে মুহূর্তে মনে হয়েছিলো ‘আমি কে?’, সেই শুভক্ষণকেই আমরা বলতে পারি মানুষের জ্ঞানার্জনের সূচনাবিন্দু। বুঝা যায়, সচেতনতার অঙ্কুরোদগমের মধ্যেই ছিলো জ্ঞানের অপার সম্ভাবনা। এরপর নিজেকে জানতে আর বুঝতে গিয়ে মানুষ দেখলো, আধার ছাড়া আধেয়কে উপলব্ধি করা অসম্ভব। তাই নিজেকে জানতে আর বুঝতে গিয়ে মানুষ তার চারপাশকে এবং একটা সময় পরে পুরো প্রকৃতিকে জানতে আর বুঝতে চেষ্টা করলো। এভাবে তার জ্ঞানার্জনের পরিধি বিস্তৃত হলো সমগ্র অস্তিত্বশীল পৃথিবীতে। কিন্তু এই বিশাল প্রকৃতিকে জানা বা বুঝার কাজ কোন একক মানুষের পক্ষে করা সম্ভব না। তাই প্রাচীনরা সৃষ্টি করলো পরম্পরাগত জ্ঞানচর্চার ইতিহাস। মানুষের জ্ঞানার্জনের ইতিহাসে পরম্পরার ভূমিকা সর্বাধিক বলে মনে হয়। পরম্পরা ধারণাটির সৃষ্টি না হলে মানুষের জ্ঞানের ক্রমোন্নতি ও ক্রমোবিকাশ কখনোই সম্ভবপর হতো না।

কিন্তু জ্ঞানের ক্রমোন্নতি ও বিকাশে পরম্পরার অস্তিত্ব থাকাটাই যথেষ্ট নয়, বরং এই পরম্পরাকে অবশ্যই হতে হবে যথার্থ ও কার্যকরী। গুরুর অর্জিত সকল জ্ঞান অধিকার করতে হবে শিষ্যকে, এরপর যদি সম্ভব হয়, তাহলে এই জ্ঞানের পরিধিকে আরেকটু বিস্তৃত করে তা আবার ছড়িয়ে দিতে হবে নিজ শিষ্যদের মধ্যে- এভাবে এই পরম্পরার চলমানতাকে রাখতে হবে কার্যকর। প্রথমেই লক্ষ্যণীয়, গুরুর অধিকৃত জ্ঞান সম্পূর্ণরূপে শিষ্যের অধিকারে না আসলে শিষ্যের পক্ষে সেই জ্ঞানে নতুন কিছু যোগ করা অসম্ভব। এই গুরু অধিকৃত জ্ঞান ধারণ করার জন্য শিষ্যের যে যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, তা অর্জন করা ক্লেশকর ও সময়সাপেক্ষ। এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরী। তা হলো, জ্ঞান বলতে এখানে শুধু তথ্যের সমাহারকেই নির্দেশ করা হচ্ছে না। জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে জানাটাই সব নয়, বরং যা জানছি তাকে বিচার, বিশ্লেষণ, যাচাই এবং সংশোধন করার মতো সামর্থ্য অর্জন করাকেই বলা হচ্ছে জ্ঞানার্জন । আধুনিক মানুষের জ্ঞানের পরিধি অনেক বিস্তৃত, কিন্তু জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় যে অসাধারণ পরিশ্রম আবশ্যক, তার পরিমাণ এখন যতটুকু ছিলো, প্রাচীনকালেও তার কম ছিলো না।

আধুনিক ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার মতো কোন সুসংবদ্ধ প্রণালি প্রাচীনকালে না থাকলেও পরম্পরার বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য সে সময়ের জ্ঞানার্জনের পথও ছিলো প্রণালিবদ্ধ। প্রাচীন ভারতবর্ষে এই জ্ঞানার্জনের দায়িত্ব ছিলো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উপর, যাদেরকে অভিহিত করা হয়েছিলো ব্রাহ্মণ নামে। হিন্দু বর্ণভেদ প্রথা নিষ্ঠুর ও অমানবিক এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রাচীন অনুন্নত ও অবিকশিত সভ্যতায় বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে এরূপ শ্রমবন্টন (Division of Labor) সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখতে পেরেছিলো। মনে রাখতে হবে, বর্ণভেদের উৎপত্তি সমাজের সব মানুষের পেশার বন্টন করে দেয়ার মাধ্যমে। সভ্যতার শুরুর দিকে সব সমাজেই বা জাতিতে এই ধরনের শ্রমবন্টন করা জরুরী ছিলো। অন্য সমাজে এই শ্রমবন্টনকে ধর্ম থেকে প্রায় পৃথক রাখা হয়েছিলো। ভারতবর্ষে যেহেতু পারমার্থিকের পাশাপাশি জাগতিক সবকিছুও ধর্মের অন্তর্ভূক্ত, সেহেতু পেশাগত বর্ণভেদের ভিত্তিও ধর্মের মধ্যেই ছিলো। তাই, ভারতবর্ষ আজও এই অসভ্য প্রথা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজন : সম্ভবত বহিরাগত আর্য্যরাই ব্রাহ্মণত্ব, ক্ষত্রিয়ত্ব ও বৈশ্যত্ব দাবি করে বসেছিলো আর এদেশের বিজিত অনার্য্য অধিবাসীদের বানিয়েছিলো শূদ্র। বিজয়ী জাতির বিজিত জাতির উপর এরূপ প্রভূত্ব করার ঘটনা অবশ্য মানুষের ইতিহাসে চিরন্তন ও সর্বব্যাপী।

আদি ব্রাহ্মণ মুনি-ঋষিদের জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল ছিলো গুরু-শিষ্য পরম্পরার উপর। গুরুর উপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হওয়াকে বিবেচনা করা হতো যেকোন শিষ্যের পরম ধর্ম হিশেবে। ভারতবর্ষে বৈদিক যুগেই লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার হলেও মুনিঋষিদের জ্ঞানান্বেষণ ও তার বিতরণ মূলতঃ ছিলো শ্রুতি-নির্ভর। শ্রুতি বলতে বুঝায় শুনে মনে রাখা। গুরুর বাক্য শিষ্যরা মনে রাখতো আর তাকে আবার তারা ছড়িয়ে দিতো তাদের শিষ্যদের মধ্যে। বৈদিক যগের প্রথমদিকের শ্রুতিনির্ভর এসব জ্ঞান পরের দিকে মুনিঋষিরা ধীরে ধীরে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেন।

কিন্তু এই জ্ঞান যখন সাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যেতে শুরু করে, তখনই সে জ্ঞান বিভিন্ন ভাবে বিকৃত ও পরিবর্তিত হতে শুরু করে। গুরুগৃহে শিষ্যদের যে নানামুখী কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হতো, সাধারণের মধ্যে সে অনুশীলনের অভাবে একদিকে গুরুবাক্যে শ্রদ্ধা রেখে জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকারও যেমনি দরকার পরলো না, তেমনি বৌদ্ধিক পরিণতির অভাবে ধর্মতত্ত্বের অনেক সূক্ষ ধারণা/ ব্যাখ্যাও সাধারণের হাতে পড়ে হয়ে গেলো স্থূল ও বিকৃত। উপরন্তু হিন্দু ধর্মতত্ত্বের যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোন ধর্মগ্রন্থ বা বিধি-বিধান ছিলো না, সেহেতু যে কারো পক্ষে এ ধর্মের বিকৃতিসাধনে কোন রকম বাধা ছিলো না। এর ফলশ্রুতিতেই আজকে আমরা হিন্দুধর্মের অসংখ্য সংস্করণ দেখি।

এভাবে সাধারণের মধ্যে জ্ঞানার্জনের পথ উন্মুক্ত করার মাধ্যমে হিন্দুধর্ম স্পষ্টতঃ দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। একটি ভাগকে আমরা বলতে পারি সংস্কৃত, বৌদ্ধিক ও সূক্ষ; আরেকটিকে বলতে পারি অসংস্কৃত, স্থূল ও বিকৃত। সাধারণের মাধ্যমে এভাবে ধর্মের বিকৃতিসাধনের ফলে আকেটি বড় ক্ষতি হয়ে গেলো : প্রাচীন পরম্পরানির্ভর কঠোর জ্ঞান অনুশীলনের যে ধারা ছিলো সেটির ধ্বংস-সাধন সম্পন্ন হলো। ফলস্বরূপ নতুন জ্ঞানার্জনের পথও হয়ে গেলো চিরতরে রুদ্ধ ।

এক্ষেত্রে পূর্বে বলা কথাই আরেকবার স্মরণ করি। এ প্রবন্ধে আমাদের উদ্দিষ্ট হিন্দুধর্মের সূক্ষ স্বরূপের সন্ধান করা। এক্ষণে এটি স্পষ্ট হওয়া জরুরী, হিন্দুধর্মের সূক্ষ স্বরূপ বুঝতে আমাদের প্রধানত নির্ভর করতে হবে এর গুরু-শিষ্য পরম্পরাগত বৌদ্ধিক জ্ঞানের উপর; সাধারণের মধ্যে প্রচলিত হিন্দুধর্ম থেকে আমাদের প্রয়োজন অনুসারে অল্প কিছু উপাদান হয়তো আমাদের বিবেচনা করতে হতে পারে, কিন্তু মোটের উপর সাধারণের হিন্দুধর্ম এ ধর্মের সূক্ষ স্বরূপ সন্ধানের কাজে বরং ব্যাপক বিঘ্নের কাজ করবে।

এ অধ্যায়ের সমাপ্তি টানার আগে অধ্যায়ের শুরুতে উত্থাপিত প্রশ্নের মীমাংসা করা আবশ্যক। প্রশ্ন উঠেছিলো, জ্ঞানার্জনের পথ কি সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে? আমাদের আলোচনায় এটি স্পষ্ট, সাধারণের জন্যে জ্ঞানের দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত করে দিলে জ্ঞানের বিশুদ্ধতা, সংস্কৃতি ও সূক্ষতার হানি ঘটে। অল্প বিদ্যা নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্করী, কারণ অল্প বিদ্যায় কোন বিষয়ের মূলে যাওয়া সম্ভবপর হয় না, আর কোন বিষয়ের মূলে না গিয়ে সেই বিষয়ের উপর আংশিক জানাশোনা থাকলে তা প্রায়ই বিশাল বিপত্তির কারণ ঘটায়। কিন্তু, জ্ঞানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে গিয়ে জ্ঞানকে যদি আমরা একটি নির্দিষ্ট অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে আবার এই অভিজাত শ্রেণীর জ্ঞানের উপর নিরঙ্কুশ অধিকার একটা সময় সমাজের অপরাপর অনভিজাত শ্রেণীর উপর শোষণ ও বর্ণবাদী আচরণের মাধ্যমে পরিণতি পায়। ইতিহাসে এই ধরনের উদাহরণের কমতি নেই। ভারতবর্ষেও ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের পতন এই প্রক্রিয়াতেই ঘটে। মনে রাখতে হবে, জ্ঞানের উপর অধিকার যার আছে, সে-ই মানুষের সমাজে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। এই অধিকার একটি সম্প্রদায়ে কেন্দ্রীভূত হলে স্বাভাবিকভাবেই তা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হবে, ফলশ্রুতিতে দেখা দিবে স্বেচ্ছাচার।

তাহলে সমাধান কী? সম্ভবত দুই বিকল্পের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে আমাদের এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। জ্ঞানের উপর সব মানুষের অধিকার থাকাই অভিপ্রেত; কিন্তু এই অধিকার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় কোনভাবেই যাতে জ্ঞানের বিশুদ্ধতা লঙ্ঘিত না হয়, তা নিশ্চিত করাও জরুরী।

 

(চতুর্থ পর্ব এখানে)

Leave a comment