মানিক বন্দোপাধ্যায়

১. বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন কিছু সময় আছে যখন এক বা একাধিক ব্যক্তি মিলে পুরো সাহিত্যের গতিটাকেই পালটে দিয়েছিলেন। মধুসূদন যেমনি পুথিনির্ভর বাঙলা পদ্যে হঠাৎ নিয়ে এসেছিলেন পশ্চিমা ভাবধারায় অনুপ্রাণিত আধুনিক কবিতা, বঙ্কিচন্দ্র এনেছিলেন উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথ তো একাই নিয়ে এলেন অনেককিছু, আবার তিরিশের পাঁচ আধুনিকরা রবীন্দ্র প্রভাবিত কবিতাকে একপাশে রেখে পুরোপুরি অন্যপথে হেঁটে গিয়ে ঘোষণা করলেন বিশ শতকী আধুনিক কবিতার দ্রোহ। এই তিরিশের কবিরা কবিতায় যা করেছিলেন মানিক কথাসাহিত্যে একাই তা করলেন। বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্র প্রবর্তিত রোমান্টিকতাকে সজ্ঞানে এবং সোৎসাহে বর্জন করে বেছে নিলেন রূঢ় অশ্লীল বাস্তবতার পথ। বাঙলা কাব্যসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা হিশেবে হয়ত শেষ বিচারে রবীন্দ্রনাথই জয়ী হবেন, তবে এক্ষেত্রে তাকে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হবে তিরিশের আধুনিকদের সাথে, কিন্তু বাঙলা কথাসাহিত্যে অনেক প্রতিভা থাকলেও এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হিশেবে নিঃসন্দেহে উচ্চারিত হবে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের নাম, এইখানে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

২. বাঙলা কথাসাহিত্যে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-বিভূতি-তারাশঙ্কর-শরৎদের মত এত মহারথী থাকতে কেনইবা মানিককে নির্দ্বিধায় বলছি সেরা কথাসাহিত্যিক? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে কথাসাহিত্য কী এবং এর উপযোগিতা ঠিক কোন জায়গায়। কথাসাহিত্যের স্বরূপ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার পরই বোধ করি আমরা বুঝতে পারবো আমাদের বাঙলা সাহিত্যে কোন কথাসাহিত্যিকের অবস্থান কোথায়। তবে এখানে একটা ব্যাপার বলে রাখা ভালো, আর সব ব্যাপারের মত সাহিত্য সম্পর্কেও একেক মানুষের ধারণা একেকরকম, এবং ফলস্বরূপ সাহিত্য থেকে মানুষের প্রত্যাশাতেও ব্যাপক ভিন্নমত রয়েছে। বর্তমান রচনায় স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান লেখকের ধারণাই প্রতিফলিত হবে। এই প্রতিফলন অধিকাংশ পাঠকের নিজস্ব প্রতিফলনের সাথে মিলবে না জেনেও বর্তমান লেখক্ এই লেখা লিখার সাহস করেছেন শুধুমাত্র বাকস্বাধীনতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার উদ্দেশ্যেই নয়, বরং তার সবচেয়ে প্রিয় কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম একজনের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদানের নিমিত্তেও।

৩. বোধ করি কথাসাহিত্যের প্রধান প্রবণতা বাস্তবতাসংলগ্নতা। সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে কল্পনার প্রেক্ষিতে কবিরা সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। কবিদের কল্পনায় কোন বাধানিষেধ তো নেইই, বরং কল্পনাপ্রবণতা কবিদের একটি আবশ্যিক ক্ষমতা হিশেবেই বিবেচিত হয়। যে কবি তার কল্পনার পরিধিকে অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করার ক্ষমতা এবং সাহস রাখেন তাকেই আমরা সফল কবি বলব, যদিও কবিতার কিছু মৌলিক শৃঙ্খলা কবিকে মানতেই হয়। কথাসাহিত্যিকেরা এদিক দিয়ে কবিদের পুরোপুরি বিপরীত। কল্পনার প্রয়োজন কথাসাহিত্যেও আছে (কল্পনা ছাড়া কোন সৃষ্টি তো আদতে অসম্ভবই), কিন্তু কথাসাহিত্যিকের স্বাধীনতা এক্ষেত্রে অনেক সংকীর্ণ। কথাসাহিত্যিক যা-ই কল্পনা করুন না কেন, তাকে মাটিতে পা রেখেই তা কল্পনা করতে হয়, কবির মত কল্পনায় ভাসতে ভাসতে মহাশূ্ন্যে উঠে যাওয়ার অবাধ স্বাধীনতা থেকে কথাসাহিত্যিক চিরদিনই বঞ্চিত।

তাই সেই কথাসাহিত্যিককেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলব যার লেখায় বাস্তবতাকে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে বাস্তবতাকে সাধারণ মানুষ যেভাবে দেখে একজন সফল কথাসাহিত্যক ঠিক সেভাবে দেখেন না, বরং তিনি নৈমিত্তিক বাস্তবতার মধ্যেও এমন কিছু খুঁজে বের করেন যা তিনি বের করার আগে আর কারোই চোখে পড়ে না, অথচ তিনি তা আবিষ্কার করার পর সবাই তা স্পষ্ট দেখতে পায়। বঙ্কিম প্রায় একাই পাশ্চাত্য রীতির উপন্যাস নিয়ে আনলেন, আর রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়ে আর সবকিছুর মতই উপন্যাসের হল ব্যাপক সংস্কার এবং উন্নতি। কিন্তু যে অর্থে উপন্যাস বা সমগ্র কথাসাহিত্যকেই বলা হয় আধুনিক যুগের এক অনন্য শিল্পমাধ্যম, সেই অর্থে মানিক একাই উপন্যাসে বিপ্লব করে ফেললেন। আপাত অসুন্দর, অশৈল্পিক এবং অশ্লীল বাস্তবতা অবশেষে ঠাঁই পেল মানিকের লেখায়। ফ্রয়েড আর মার্কস এর যুগপৎ অবস্থান যেন বিশ শতকী আধুনিকতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, একই সাথে সামষ্টিক বোধ আর সাম্যবাদী চিন্তার এক জগাখিচুড়ি। এই আধুনিকতাকে আমরা প্রথম পাই কবিতার ক্ষেত্রে পাঁচ আধুনিকে, আর কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে এক মানিকে। দিবারাত্রির কাব্য-তে আমরা এক অপরিণত মানিককে পাই, জননীতে পাই ক্রমশ বিকশিত হওয়ার মধ্যে থাকা মানিককে, আর প্রথমবারের মত পুতুল নাচের ইতিকথা-তে পাই সম্পূর্ণ মানিককে। পুতুল নাচের ইতিকথা আর পদ্মা নদীর মাঝি বাঙলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসের মোড় ঘুরানো দুই উপন্যাস, যাদের পর বাঙলা উপন্যাস আর আগের মত থাকেনি। যদিও দুভার্গ্যক্রমে অনেক দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর লেখকদের অপাচ্য উপন্যাসে বাঙলা সাহিত্য ক্রমশ নষ্টদের অধিকারে গিয়েছে বা যাচ্ছে, তারপরও মানিকের পর কমপক্ষে পাঁচ বা ছয়জন মহত ঔপন্যাসিক আমরা পেয়ে গেছি; বলা বাহুল্য মানিকের আবির্ভাব না হলে এদের কারোই আবির্ভাব হত না। মানিকের সমসাময়িক (প্রচলিত মতে আরও দুই মহত ঔপন্যাসিক) বিভূতি আর তারশঙ্করের কোন সুদূরপ্রসারী প্রভাব বাঙলা সাহিত্যে দৃষ্ট হয়না। তাদের উপন্যাস থেকে নতুন কিছু বাঙলা সাহিত্য পেয়েছে বলে মনে হয়না। অন্তত এতটুকু বলাই যায় বিভূতি বা তারাশঙ্করের একজনও মানিকের মত সম্পূর্ণ একার চেষ্টায় বাঙলা সাহিত্যের মোড় ঘুরাতে পারেননি।

৪. মানিকের কোন্ বৈশিষ্ট্য তার সমসাময়িক দুই ‘মহত’ ঔপন্যাসিক থেকে তাকে আলাদা করেছে?- এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় এই তিন ঔপন্যাসিকের তিনটি প্রধান উপন্যাস ক্রমান্বয়ে পড়া। পুতুল নাচের ইতিকথা, পথের পাঁচালী, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা- এই তিনটিকেই ধরা যাক। পথের পাঁচালী দারুণ উপভোগ্য এক উপন্যাস, দুই ভাইবোনের শৈশবের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বলার মধ্যে দিয়ে বিভূতি প্রমাণ করেছেন তিনি উপন্যাসের মধ্যেও অসংখ্য অসাধারণ চিত্রকল্পের জন্ম দিতে পারেন। অন্যদিকে তারাশঙ্করের উপকথায় আমরা পাই এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উত্থান-পতনের ইতিহাস। এই উপন্যাস প্রমাণ করে তারাশঙ্করের অভিজ্ঞতার ঋদ্ধতাকে, একই সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি তার সংবেদনশীলতাকেও। কিন্তু এই দুই উপন্যাসের একটিতেও যা পাইনা তা পুতুল নাচের প্রতিটা পৃষ্ঠায় পেতে থাকি। এই প্রথম আমরা পাই ব্যক্তি মানুষকে। মানুষের একদম ভেতরে ডুব দিয়ে তার স্বরূপটা মানিক প্রকাশ করতে থাকেন পুতুল নাচের প্রতিটা পৃষ্ঠায়। পুতুলনাচে কোন নাটকীয় ঘটনা পাই না, প্রকৃতিকেও প্রায় অনুপস্থিত ধরা যায়, কিন্তু পাই কালজয়ী কিছু চরিত্র। এবং প্রতিটা চরিত্র কতই না আলাদা! আবার একইসাথে কতই না অভিন্ন! এই আপাত বিভিন্নতা এবং শেষবিচারে অভিন্নতাই বোধহয় মানুষের একমাত্র সঠিক প্রকৃতি। মানিক প্রথমবারের মত বাঙলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে বাস্তবতাকে উন্মুক্ত করেন। তিনিই প্রথম মানুষকে, তার সমগ্র সত্তা নিয়ে, ধরতে সক্ষম হন। তার বাস্তবসংলগ্নতা তাকে খুব সহজেই পৃথক করে তার সমসাময়িক অন্য যেকোন ঔপন্যাসিক থেকে। তার মত সামগ্রিকতাবোধ, যাকে ধরা হয় যেকোন ঔপন্যাসিকের সবচেয়ে বড় গুণ, আর কারও মধ্যেই তার সমসাময়িককালে পাওয়া যায়না।

৫. মানিকের পরের সব গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিকের মধ্যেই মানিকের ছায়া দেখা যায়, যেমনি রবীন্দ্রনাথের পর স্বল্প সময়ের জন্য সব কবির মধ্যেই তার প্রভাব দেখা গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে বাঙলার কবিরা অনেক আগেই মুক্ত হতে পেরেছেন, কিন্তু মানিককে এড়িয়ে যাওয়া বোধকরি এখনও সম্ভব হয়নি। এমনকী বিশ শতকের শেষভাগের গুরুত্বপূর্ণ জাদুবাস্তবময় কথাশিল্পী শহীদুল জহিরকে পড়তে গিয়েও তাই মাঝেমাঝে মানিককে দেখতে পাই। মনে হয় ওয়ালীউল্লাহ, ইলিয়াস, হাসান, বা জহির এরা সবাই মানিকের দেখানো পথেই হেঁটেছেন। এরা সবাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য, কিন্তু এদের সবার চেতনার ভেতরে ঠিকই মানিক বন্দোপাধ্যায় বাস করতেন; খুব সম্ভবত এজন্যই তারা মানিকের মতই সামগ্রিকতাবোধ লাভ করতে পেরেছিলেন, আর এই কারণেই তারা নিজেরা একেকজন হয়ে উঠেছিলেন মহত কথাসাহিত্যিক। তাই এদেরকে এদের প্রাপ্য কৃতিত্ব দেওয়ার পরও বলতে হয়, বাঙলা সাহিত্যে মহত ঔপন্যাসিক অনেক থাকলেও শ্রেষ্ঠ একজনই ছিলেন, আছেন, এবং, খুব অবিশ্বাস্য কেউ না আসলে, থাকবেন।

(নভেম্বর ১৭, ২০১৪)

Leave a comment